গত ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারের নির্বাচন মার্কিন জনগণের কাছে একটু ব্যতিক্রম ও ভিন্নরকম গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ, সমগ্র বিশ্ব এখন করোনার মতো এক ভয়াবহ নতুন বৈশ্বিক সংকটের মুখোমুখি, যার প্রভাব সবচাইতে বেশি পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে প্রায় ১ কোটি লোক এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে কোভিড-১৯ এ এবং মৃত্যু বরণ করেছে ২ লক্ষ ৩৮ হাজারের উপরে, যা পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। করোনার প্রভাব সমানভাবে পড়েছে অর্থনীতির উপর। গত জুলাইয়ের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রায় ২ কোটি ২০ লাখের উপর মার্কিন নাগরিক করোনা মহামারীর কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এই বছরের মাঝামঝি সময়ে পিউ রিসার্স সেন্টার (Pew Research Center) এক গবেষণায় তুলে ধরেছে ৯১% আমেরিকান মনে করে যে, কোভিড-১৯ এর ফলে তাদের জীবনে কোন না কোন প্রভাব পড়েছে। ঠিক এমন এক বাস্তবতার মধ্যেই মার্কিন জনগণ এবারের নির্বাচনে তাদের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনকে বেছে নিলেন।
এবারের নির্বাচন আরও কিছু ভিন্ন কারণে সে দেশের জনগণের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, তা হলো; গত নির্বাচনে হিলারী ক্লিনটনকে পরাজিত করে যিনি রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ক্ষমতায় এসেছিলেন অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্প যার মূল স্লোগান ছিলো আমেরিকাই প্রথম (আমেরিকা ফার্ষ্ট) অথবা (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) এসব স্লোগানে আস্থা রাখা মার্কিন জনগণ নির্বাচন পরবর্তী ৪ বছরে তার প্রশাসনের কাছ থেকে সেই আমেরিকাকে মহান করার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রাপ্তির মিল খুঁজে পায়নি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই একে একে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো; ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি বাণিজ্য চুক্তি, প্যারিস জলবায়ূ চুক্তি, ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত ৬ জাতি শান্তি চুক্তি ও বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা থেকে বের হয়ে আসা। এ সকল কারণে সচেতন মার্কিন জনগণ মনে করে যে ট্রাম্প “আমেরিকা ফার্ষ্ট” একথা বললেও মূলত: আমেরিকাকে পরাশক্তির আসন থেকে ক্রমশই গুটিয়ে নিচ্ছে। তার পররাষ্ট্রনীতি চলতো ব্যক্তি সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে, যার ফলে ট্রেডিশনাল পলিটিক্স তার শাসনকালে ছিলো অনেকটাই অনুপস্থিত । দীর্ঘ দিনের ন্যাটো মিত্রদের অনেকেই আশাহত হয়েছে তাঁর এসব পলিসির কারণে। তার এসব দূর্বল কিংবা ভুল পররাষ্ট্রনীতির কারণে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্রদের অনেকেই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এবং অনেক জায়গায় চীন, রাশিয়া বাণিজ্যিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নেয়। নিজ দেশে নারীর প্রতি অসম্মান সূচক বক্তব্য, দুই মুসলিম কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর ও রাশিদা তালিবকে আক্রমন করে তিনি বলেন (তোমরা যেখান থেকে এসেছো সেই দেশে চলে যাও) সহ অসংখ্য বিতর্কিত বিষয়ের জন্ম দেন। এছাড়াও তার বর্ণবাদী বিভিন্ন মন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে একিভূত করার পরিবর্তে তাদের মাঝে বিভাজন রেখা সৃষ্টি করে, যার সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে সাদা পুলিশ কর্তৃক (কালো)জর্জ ফ্লয়েড হত্যার মতো ঘটনা মার্কিন জনগণ প্রতক্ষ্য করে ।
কেমন হবে জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি?
বেশ কিছু চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে এগোতে হবে জো বাইডেনকে, ডমেস্টিক এবং গ্লোবাল রাজনীতিতে ট্রাম্প শাসনামলের ক্ষতকে কাটিয়ে উঠে পাশাপাশি এগিয়ে যেতে হবে। এমন বাস্তবতার কথা তিনি নির্বাচনের ফলাফল জানার পর জাতির উদ্যেশে দেওয়া প্রথম ভাষণেই বলেন। নিজেকে আমেরিকানদের পূণ:ঐক্যবদ্ধকারী দাবী করে জো বাইডেন বলেন; রিপাবলিকানদের পরিচালিত পথ থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদেরকে আমেরিকার আত্মা পূন:প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একথার মধ্য দিয়ে মূলত: বাইডেন তার অভ্যন্তরীন ও পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে তার একটা পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, কভিড-১৯ মোকাবেলা, কর্মহীনদের কর্মসংস্থান ও দেশের ভিতরে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, এসব হবে তার অভন্ত্যরীণ চ্যালেঞ্জ। দেশের বাহিরে তথা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চ্যালেঞ্জটা বেশ বড় বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা । কেননা চীনের সাথে চলমান শীতল বাণিজ্য যুদ্ধের বর্তমান চিত্র একেবারেই ভিন্নতর । কারন চীন এখন বানিজ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ সম্প্রসারণশীল। তবে অনেকেই মনে করেন চীনের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের মতো কঠোর নীতিই অনুসরণ করবেন বাইডেন। বাণিজ্য প্রতিযোগীতায় নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে আরও সুসংহতভাবে পথ চলবেন বলেই অনেকের ধারণা। পাশাপাশি বিগত ৪ বছরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখার ফলে চীনসহ অন্যান্য দেশের উপস্থিতির বিপরীতে নিজেদের অবস্থার পূণ:প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জটাও কম হবেনা তাদের জন্য। এশিয়ায় আরেক মিত্র ইন্ডিয়ার সাথে কৌশলগত সুসম্পর্ক্য বিদ্যমান থাকলেও মোদি’র বিজিপির জন্য বাইডেন প্রশাসন ইতিবাচক হবেনা বলে মন্তব্য করেছেন সিডনি ইউনিভার্সিটির একজন এসোসিয়েট প্রফেসর ‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় লেখা গত ৭ নভেম্বর তার এক যৌথ নিবন্ধে। তিনি বলেন যদিও জো বাইডেনের রার্নিংমেট কমলা হ্যারিস হতে যাচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট, যিনি একজন দক্ষিণ ইন্ডিয়ান বংশতভূত। লেখক সেলভেটর ব্যাবনস্-এর মতে, কমলা হ্যারিস আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের জন্য গর্ব ও আনন্দের বিষয় হলেও অতটা আনন্দের কারণ হবেনা বিজিপি’র মোদি সরকারের জন্য। কমলা হ্যারিস আগাগোড়াই কাশ্মির ইস্যুতে মোদি সরকারের সমালোচনা করে আসছে। কাশ্মিরে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার ও সেদেশে মুসলমানদের প্রতি সাম্প্রতিক বিভিন্ন বৈষম্যেরও তিনি জোড়ালো সমালোচক। এসব কারণে নতুন মার্কিন সরকারের ইন্ডিয়ানীতি এখনও পরিস্কার করে বলে দেওয়া যায়না। ভারতের মতো পাকিস্তানের সাথেও সম্পর্ক হতে পারে চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের উপর দৃষ্টি রেখে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় আয়তনে ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এমন দেশ যেমন; শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, নেপাল সহ অন্যান্য দেশ গুলোর সাথে সম্পর্ক পূনর্বিণ্যাসে বাইডেন প্রশাসন আগ্রহী হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সাথে চলমান মার্কিন অবস্থার কিছু কৌশলগত পরিবর্তন আসতে পারে। ট্রাম্পের একতরফা ৬ জাতি চুক্তি থেকে সরে আসায় যে সংকট তৈরী হয়েছে সেখানে একটি নতুন সমঝোতার চেষ্টা হয়তো থাকবে নতুন সরকারের। সৌদি আরবের সাথে ট্রাম্প সরকারের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে যে মূল্যায়ন চলমান ছিলো সে অবস্থান আগের মতো আর থাকেছে না বলেই মনে হয়। তুরস্কে সৌদি নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকান্ডের সময় এর যথাযথ বিচার চেয়ে সোচ্চার ছিলেন জো বাইডেন। সুতরাং সৌদি রাজ পরিবারের প্রতি একচেটিয়া ট্রাম্পের সমর্থনের ইতি ঘটবে এমনটাই মনে হচ্ছে। এর ফলে ইয়েমেনের সাথে সৌদি যুদ্ধের দিকটাও নতুন মোড় নিবে হয়তো। সিরিয়ায় আর নতুন করে জড়াতে চাইবেনা আমেরিকা। তবে এসব কিছুর অনেকটাই নির্ভর করবে জো বাইডেনের ইসরাইলনীতির উপর। বিজ্ঞজনদের ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেডিশনাল পলিটিক্সে ইসরাইলকে সর্বাত্মক সমর্থন করে যাওয়ার ইতিহাসই এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান। সুতরাং বাইডেনের ইসরাইল নীতির খুব বেশি হেরফের হবে বলে মনে হয়না। তবে ট্রাম্পের মতো সকল আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে জেরুজালেমে নিজেরে দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার মতো বিষয় হয়তো নাও ঘটতে পারে। আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির যে নীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এতোকাল দেখা যেতো সেপথেই হয়তো হাটবেন জো বাইডেন।
তুরস্কের সাথে সম্পর্ক আগের মতো চেক এন্ড ব্যালেন্স থাকার সম্ভাবনাই বেশি, তবে ইউরোপ মিত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কখনো কখনো একপেশে নীতি পরিলক্ষিত হতে পারে তুরস্কের ক্ষেত্রে, কেননা জলবায়ু চুক্তি কিংবা ট্রান্স প্যাসিফিক চুক্তিসহ অন্যান্য চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিরতে চাইলে ইউরোপিয় মিত্রদের কোনো কোনো দেশ থেকে তুরস্ককে কোণঠাসা করার শর্ত বা দাবি সামনে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে একপেশে অবস্থান পরিলক্ষিত হলেও হয়তো সুদূর প্রসারী দৃষ্টি ভংগী থেকে তা খুব জোড়ালো হবেনা। কারণ, তুরস্কের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি মধ্যপন্থার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে, তাই তুরস্কের প্রতি বিশেষ চাপ সৃষ্টি করে ন্যাটো সদস্য দেশটিকে একচেটিয়া রাশিয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া কোনো ভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকুলে হবেনা। রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগের চাইতে আরও শীতলতা পরিলক্ষিত হতে পারে। কারণ, ধারণা করা হয় ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে রাশিয়ার হাত ছিলো এবং এ ব্যাপারে নির্বাচনের পর ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে সে সময় অভিযোগ করা হয়েছিলো। যদি এই অনুমান সত্যি হয় তাহলে দু’দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আগের চাইতে আরও বেশি দ্বিমুখী অবস্থান ও প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হবে।
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জো বাইডেনকে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তার দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য, করোনা মোকাবেলা ও অর্থনীতি চাঙ্গা করাসহ কর্মহীনদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ইত্যকার বিষয়ে । তাঁর নির্বাচন পরবর্তী জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম ভাষণেই এসব চ্যালেঞ্জের কথা তিনি তুলে ধরেন। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পূর্বাবস্থানে ফিরে আসার জন্য বড় চ্যালেঞ্জও কিন্তু সেই অর্থনীতি! সম্পর্ক স্বাভাবিকি করণের যে কোন উদ্যোগের প্রথমেই অর্থনৈতিক সহযোগীতা বা বিনিয়োগ প্রস্তাবনা অগ্রাধিকার পাবে। যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বিনিয়োগ ছাড়া ভিন্ন কোন সহায়তা প্রস্তাব আন্তর্জাতিক সহযোগীতায় অতটা গুরুত্ব পাবে বলে মনে হয়না, বিশেষ করে এই করোনাকালীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময় সকল দেশের কাছেই অর্থনৈতিক ইস্যুটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
দৈনিক আজকাল (ই,স)
Leave a Reply